এ্যারিস্টটল / অ্যারিস্টটল এর জীবনী
বিশ্ববিজয়ী বীর সম্রাট আলেকজান্ডার দুঃখ করে বলেছিলেন জয় করার জন্য পৃথিবীর আর কোনো দেশই বাকি রইল না। তার শিক্ষক মহাপণ্ডিত অ্যারিস্টটল সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। জ্ঞানের এমন কোনো দিক নেই তিনি যার পথপ্রদর্শক নন। Politics তার গ্রন্থ আধুনিক রাষ্ট্রনীতির সূচনা করেছে। Politics গ্রন্থের নাট্যতত্ত্ব কাব্যতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে। আধুনিক জীবনবিজ্ঞানের তিনিই জনক। বহু দার্শনিক তত্ত্বের প্রবক্তা। তার চিন্তা জ্ঞান মনীষা প্রায় দুই হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতাকে বিকশিত করেছিল।
৩৮৪ খ্রিষ্টপূর্বে থ্রেসের অন্তর্গত স্তাজেইরা শহরে অ্যারিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন চিকিৎসক। নাম নিকোমাকাস।
শৈশবে গৃহেই পড়াশোনা করেন অ্যারিস্টটল। ১৭ বছর বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে গৃহত্যাগ করেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এথেন্সে এসে উপস্থিত হন। সেই সময় এথেন্স ছিল শিক্ষার কেন্দ্র। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো গড়ে তুলেছেন নতুন একাডেমিক। সেখানে ভর্তি হলেন অ্যারিস্টটল। অল্পদিনের মধ্যেই নিজের যোগ্যতায় তিনি হয়ে উঠলেন একাডেমির সেরা ছাত্র। প্লেটোও তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।
শিক্ষাদান ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ করতেন অ্যারিস্টটল-তর্কবিদ্যা, অধিবিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র। অল্পদিনের মধ্যেই তার গভীর জ্ঞান, অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কথা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপেরও অজ্ঞাত ছিল না। পুত্র আলেকজান্ডারের জন্ম সময়েই তার শিক্ষার ভার অর্পণ করেন অ্যারিস্টটলের ওপর। তখন অ্যারিস্টটল আটাশ বছরের যুবক।
আলেকজান্ডার যখন তেরো বছরের কিশোর, রাজা ফিলিপের আমন্ত্রণে অ্যারিস্টটল এসে তার শিক্ষার ভার গ্রহণ করলেন। শ্রেষ্ঠ গুরুর দিগ্বিজয়ী ছাত্র। বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক ধারণা অ্যারিস্টটলের শিক্ষা উপদেশই আলেকজান্ডারের অদম্য মনোবল লৌহকঠিন দৃঢ় চরিত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে একজনের ছিল সমগ্র পৃথিবীকে জয় করে তার ওপর প্রভুত্ব করার প্রবল ইচ্ছা। অন্যজনের ছিল জ্ঞানের নতুন নতুন জগৎ আবিষকার করে মানুষের জন্য তাকে চালিত করার ইচ্ছা।
অ্যারিস্টটলের প্রতি রাজা ফিলিপেরও ছিল গভীর শ্রদ্ধা। শুধু পুত্রের শিক্ষক হিসেবে নয়, যথার্থ জ্ঞানী হিসেবেও তাকে সমমান করতেন। অ্যারিস্টটলের জন্মস্থান স্তাজেইরা কিছু দুর্বৃত্তের হাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেখানকার মানুষ বন্দি জীবন যাপন করছিল। রাজা ফিলিপ অ্যারিস্টটলের ইচ্ছায় শত্রুসেনার হাত থেকে শুধু স্তাজেইরা উদ্ধার করেননি, ধ্বংসসতূপের মধ্যে থেকে শহরকে নতুন করে গড়ে তুললেন।
অ্যারিস্টটল একদিকে ছিলেন মহাজ্ঞানী, অন্যদিকে সার্থক শিক্ষক। তাই গুরুর প্রতি আলেকজান্ডারের ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তিনি বলতেন, পিতার কাছে পেয়েছি আমার এই জীবন আর গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করেছি কীভাবে এই জীবনকে সার্থক করা যায় তার জ্ঞান। যখন অ্যারিস্টটল জীবন বিজ্ঞানসংক্রান্ত গবেষণার কাজ করছিলেন, আলেকজান্ডার তার সাহায্যের জন্য বহু মানুষকে নিযুক্ত করেছিলেন, যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের মাছ, পাখি, জীবজন্তুদের জীবন পর্যবেক্ষণ করা, তার বিবরণ সংগ্রহ করে পাঠানো। দেশ-বিদেশের যেখানেই কোনো পুঁথি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যেত, আলেকজান্ডার যে কোনো মূল্যেই হোক সেই পুঁথি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে গুরুর হাতে তুলে দিতেন।
যখন আলেকজান্ডার এশিয়া জয়ের নেশায় সৈন্যবাহিনী নিয়ে বের হলেন, অ্যারিস্টটল ফিরে গেলেন এথেন্সে। তখন এথেন্স ছিল শিল্প সংস্কৃতি শিক্ষার পীঠস্থান। এখানেই স্কুল স্থাপন করলেন অ্যারিস্টটল। তখন তার বয়স পঞ্চাশ বছর। স্কুলের নাম রাখা হলো লাইসিয়াম। কারণ কাছেই ছিল গ্রিক দেবতা লাইসিয়ামের মন্দির।
৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যু হলো। এত দিন বীর ছাত্রের ছত্রছায়ায় যে জীবনযাপন করতেন তাতে বিপর্যয় নেমে এলো। কয়েকজন অনুগত ছাত্রের কাছ থেকে সংবাদ পেলেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সক্রেটিসের অন্তিম পরিণতির কথা অজানা ছিল না অ্যারিস্টটলের। তাই গোপনে এথেন্স ত্যাগ করে হইরিয়া দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু এই স্বেচ্ছানির্বাসনের যন্ত্রণা বেশিদিন ভোগ করতে হয়নি অ্যারিস্টটলকে। ৩২২ খ্রিষ্টপূর্বে তার মৃত্যু হলো।
অ্যারিস্টটলের রচনা
অ্যারিস্টটল সমস্ত জীবন ধরে যে সমস্ত রচনা করে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে তা তার শিষ্য থিওফ্রাস্তোসের হাতে দিয়ে যান। থিওফ্রাস্তোর পর সেই সমস্ত রচনার উত্তরাধিকারী হন তার শিষ্য নেলেওস। নেলেওসের মৃত্যুর পর তার পুত্ররা সেই সমস্ত রচনাকে লোহার সিন্দুকে ভরে অ্যারিস্টটলের সমাধির নিচে পুঁতে রাখেন। দুশো বছর পর রোমের সেনাবাহিনী যখন গ্রিস দখল করে তখন সেই পুঁথি উদ্ধার করে রোমে নিয়ে আসা হলো। সমস্ত রচনাই জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বহু প্রচেষ্টায় সেই সমস্ত পুঁথির অনুলিপি প্রস্তুত করা হলো এবং তার ভিত্তিতেই অ্যারিস্টটলের রচনাবলি প্রকাশিত হয়। বিষয়বস্তু অনুসারে অ্যারিস্টটলের রচনাবলিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়-তর্কবিদ্যা, অধিবিদ্যা (Metaphysics), প্রকৃতিবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, অলংকারতত্ত্ব, কাব্যতত্ত্ব।
অ্যারিস্টটলের রচনার সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি। তবে এর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সামান্য যা কিছু পাওয়া গেছে তা থেকেই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, কী ব্যাপক ছিল তার প্রতিভা। ভুল-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তিনিই প্রথম মানুষের কাছে জ্ঞানের মশালকে তুলে ধরেন।
তার রচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মেটাফিজিকস (অধিবিদ্যা) এবং এথিক্স (নীতিশাস্ত্র)। এই বইগুলোর মধ্যে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন জীবন গতিশীল এবং ক্রমাগতই তার বিকাশ ঘটছে। এই সমস্ত রচনার মধ্যে অনেক নির্ভুল তত্ত্ব থাকলেও জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে যুক্তির চেয়ে কল্পনার ও অযৌক্তিক ধারণার প্রভাবই বেশি। এর কারণ কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই এসব বিষয়ে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। যেমন তিনি বলতেন যদি একই সাথে একটি ভারী ও হালকা বস্তুকে ওপর থেকে ফেলা হয় তবে ভারী বস্তুটি আগে পড়বে। বহু শত বছর পর গ্যালিলিও প্রমাণ করলেন (পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে) দুটি বস্তুই একই সাথে মাটিতে পড়বে।
এছাড়া তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই স্থির। তাকে গতিশীল করার জন্য বল প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রেও অ্যারিস্টটলের অধিকাংশ মতামতই ছিল ভ্রান্ত। অ্যারিস্টটল লিখেছিলেন পৃথিবী স্থির। তাকে কেন্দ্র করে সৌরজগতের চাঁদ তারা সূর্য জ্যামিতিক পথে ঘুরছে। গ্যালিলিও প্রথম এই ধারণাকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেন। তার অভিমত ছিল চাঁদের নিজস্ব আলো আছে। উত্তরকালে প্রমাণিত হয়েছে চাঁদের কোনো আলো নেই।
অ্যারিস্টটলের এসব ভ্রান্ত মতামত কয়েক শতাব্দী ধরে সমাজকে চালিত করেছে। তার জন্য অ্যারিস্টটলকে অভিযুক্ত করা যায় না। উত্তরকালের মানুষেরই দায়িত্ব ছিল তার গবেষণার সঠিক মূল্যায়ন করা। কিন্তু সে কাজে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল।
সমস্ত ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও অ্যারিস্টটল মানব ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠতর প্রজ্ঞা-যার সৃষ্ট জ্ঞানের আলোয় মানুষ নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে, মহত্তর পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
Leave a Message